SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - হিন্দু ধর্ম শিক্ষা - NCTB BOOK
Content added By

আমরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে জেনেছি, পূজা শব্দের অর্থ প্রশংসা করা বা শ্রদ্ধা করা। নিরাকার ঈশ্বরের সাকার রূপ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন দেব-দেবীকে আমরা বিভিন্নভাবে আরাধনা করি। ফুল-ফল ও নানা উপচার দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। এই শ্রদ্ধা নিবেদন করার প্রক্রিয়াই হলো পূজা। পূজার মাধ্যমে সকল অশুভ শক্তি দূর হয়। জীবের কল্যাণ সাধিত হয়। আবহমান কাল থেকে আমাদের প্রাত্যহিক ও সামাজিক জীবনে মঙ্গল কামনায় যে সমস্ত আনন্দ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা করা হয় তা-ই পার্বণ। এখন আমরা কয়েকজন দেব-দেবী সম্পর্কে জানব।

লক্ষ্মীদেবীর পরিচয়

লক্ষ্মীদেবী ধনসম্পদ, সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য ও সৌন্দর্যের দেবী। তাঁর অপর নাম শ্রী। তিনি সত্ত্বগুণময়ী। দেবী লক্ষ্মী ভগবান বিষ্ণুর সহধর্মিণী। তিনি স্নিগ্ধতা ও সুন্দরের প্রতীক। আমাদের পরিবার ও সমাজের উন্নতি নির্ভর করে সম্পদের ওপর। এই সম্পদগুলোর মধ্যে ভূমি, শস্য, জ্ঞান, সততা, শুদ্ধতা ইত্যাদি অন্যতম। এসব সম্পদ অর্জনের জন্য লক্ষ্মীদেবীর পূজা করা হয়।

লক্ষ্মীদেবী পদ্মফুলের ওপর উপবিষ্ট। তিনি গৌরবর্ণা। তাঁর দুটি হাত। এক হাতে তিনি ধরে থাকেন পদ্ম আরেক হাতে অমৃতের কলস। তাঁর বাহন পেঁচা। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মীপূজা করা হয়। এ পূজা কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা নামে পরিচিত। এছাড়া প্রতি বৃহস্পতিবার বাংলার ঘরে ঘরে পাঁচালী পড়েও লক্ষ্মীপূজা করা হয়।

পূজা পদ্ধতি

যে কোনো পূজা করতে পূজা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। পূজার ক্ষেত্রে শুদ্ধ আসনে বসে আচমন থেকে শুরু করে পঞ্চদেবতার পূজা করতে হয়। এ পূজায় বিভিন্ন ধরনের আল্পনা বা চিত্র আঁকা হয়।

বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে লক্ষ্মীদেবীর পূজা করা হয়। লক্ষ্মীপূজা পঞ্চোপচার, দশোপচার বা ষোড়শ উপচারে করা হয়ে থাকে। পূজায় ধানের ছড়া, পঞ্চশস্য, সোনা, রূপা, কাঁচা হলুদ, মধু, দধি ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহার করা হয়। নলটুলীফুল ও পদ্মফুল লক্ষ্মীদেবীর প্রিয় ফুল। এ পূজার মৌলিক নীতি হিসেবে দেবী লক্ষ্মীর ধ্যান, পুষ্পাঞ্জলিমন্ত্র, পুষ্পাঞ্জলি প্রদান, প্রণামমন্ত্র পাঠ প্রভৃতি করতে হয়। অবশেষে লক্ষ্মীদেবীর পাঁচালি পাঠ করে এয়োগণ একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে দেন।

 

লক্ষ্মীদেবীর পুষ্পাঞ্জলিমন্ত্র

ওঁ নমস্তে সর্বভূতানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে। 

যা গতিস্তৎ প্রপন্নানাং সা মে ভূয়াত্ত্বদর্চনাৎ ।

শব্দার্থ : ওঁ নমস্তে - নমস্কার বা প্রণাম; সর্বভূতানাং - সকল প্রাণীর; বরদাসি - আশীর্বাদ বা মঙ্গল; হরিপ্রিয়ে - - হে হরিপ্রিয়া; যা - যে, গতিঃ - গতি, তৎ - তার; প্রপন্নানাং - আশ্রিত বা শরণাগত; সা - তার; মে - আমার; ভূয়াত্ত্বদৰ্চনাৎ ( ভূয়াৎ তু অদচনাৎ) - প্রচুর বা অধিক অৰ্চনা ।

সরলার্থ : হে হরিপ্রিয়া, তুমি সকল প্রাণীর মঙ্গল করে থাক। তোমার আশ্রিতদের যে গতি হয়, তোমার অধিক অর্চনার দ্বারা আমারও যেন সেই গতি হয়। তোমাকে নমস্কার।

 

লক্ষ্মীদেবীর প্রণামমন্ত্ৰ

ওঁ বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে। 

সর্বতঃ পাহি মাং দেবি মহালক্ষ্মী নমোহস্তু তে।

শব্দার্থ : বিশ্বরূপস্য - বিশ্বরূপের; ভার্যাসি - বিষ্ণুর স্ত্রী; পদ্মে - পদ্মা; পদ্মালয়ে - পদ্মের আলয়; শুভে - শুভফল; - সবদিক থেকে; পাহি - রক্ষা করো; মাং - আমাকে; মহালক্ষ্মী - মহালক্ষ্মী; নমোহস্তুতে –তোমাকে - সবতঃ – নমস্কার।

সরলার্থ :  হে দেবী মহালক্ষ্মী, বিশ্বরূপ শ্রীবিষ্ণুর সহধর্মিণী, তুমি পদ্মা, পদ্মের আলয়ে বাস করো। তুমি সকলকে শুভফল দাও। আমাকেও সকল ক্ষেত্রে রক্ষা করো। তোমাকে প্রণাম করি।

লক্ষ্মীপূজার গুরুত্ব:

লক্ষ্মীপূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় প্রতি হিন্দু বাঙালি গৃহেই সাড়ম্বরে লক্ষ্মীদেবীর পূজা হয়। আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথি ছাড়াও প্রতি বৃহস্পতিবার এবং বিশেষ বিশেষ পূর্ণিমা তিথিতে দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। দেবী লক্ষ্মী ধনসম্পদের দেবী। তিনি পূজারীকে ধনসম্পদ দান করে থাকেন। লক্ষ্মীদেবীর পূজা করলে সংসারের শ্রী বৃদ্ধি হয়। পূজারীর মন শান্ত হয়। সেই সাথে সংসারে শান্তি স্থাপিত হয়। লক্ষ্মীপূজায় বিভিন্ন নকশার চিত্র এবং আল্পনা আঁকা হয়। এই আল্পনার মধ্যে ধানের ছড়া, লক্ষ্মীদেবীর পায়ের ছাপ, বিভিন্ন মুদ্রার ছাপ, পেঁচার পায়ের ছাপ ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলা হয়। এর মাধ্যমে সাধারণ গৃহবধূদের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এই পূজার মাধ্যমে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ একে অপরের অনেক কাছে চলে আসে। তাদের মধ্যে কুশল বিনিময় হয়। এতে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের গভীরতা আরও বৃদ্ধি পায়। ।

নারায়ণদেবের পরিচয়

ভগবান বিষ্ণুর অপর নাম নারায়ণ। তাকে বাস্তুদেবতাও বলা হয়। তিনি পাপ মোচন ও বিঘ্ন নাশকারী দেবতা। ‘নার’ বা ‘নারা” শব্দের অর্থ মানুষ এবং ‘অয়ন' শব্দের অর্থ আশ্রয়। সুতরাং নারায়ণ শব্দের অর্থ সব মানুষ বা সব জীবের আশ্রয়স্থল। তিনি পরমাত্মা, পরমব্রহ্ম ও পরমেশ্বর নামেও পরিচিত। নারায়ণদেবের গায়ের রং উজ্জ্বল নীল। তাঁর চারটি হাতে যথাক্রমে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম শোভা পায়। দুষ্টের বিনাশের জন্য তিনি যেমন গদা ও চক্র ধারণ করেন। ঠিক তেমনি সৎ ও সাধুদের রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর হৃদয় হয়ে ওঠে পদ্মের মতো কোমল। তিনি এ জগতের সব প্রাণীর পালন করে থাকেন, এ কারণে তাঁকে সকল প্রাণীর পালনকর্তা বলা হয়। তাঁর বাহন গরুড় পাখি ।


পূজা পদ্ধতি

প্রতিমারূপে, শালগ্রাম শিলারূপে, তাম্রপাত্রে বা জলে নারায়ণ পূজা করা হয়। পঞ্চশস্য, পঞ্চধাতু এবং বিভিন্ন উপচারে নারায়ণ পূজা করা হয়। সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা গৃহ প্রবেশ বা যে কোনো শুভ সূচনাতে নারায়ণ পূজা করে থাকে। বিশেষভাবে নির্ধারিত মন্ত্রে নারায়ণ পূজা করা হয়। পূজা শেষে ব্রতকথা শ্রবণ করে আরতি করা হয়। সাদা ও হলুদ ফুল এবং তুলসীপাতা নারায়ণের খুব প্রিয়। যে কোনো মাসের সংক্রান্তিতে, শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে অথবা বৈশাখ মাসে নারায়ণ পূজার প্রচলন বেশি লক্ষ করা যায়।

নারায়ণ দেব

 

নারায়ণদেবের পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্ৰ

ওঁ নমস্তে বিশ্বরূপায় শঙ্খচক্রধরায় চ।
পদ্মনাভায় দেবায় হৃষীকপতয়ে নমঃ।।

শব্দার্থ : ওঁ নমস্তে-তোমাকে নমস্কার; বিশ্বরূপায় - বিশ্বরূপকে; শঙ্খচক্রধরায় - শঙ্খচক্রধারীকে; চ - এবং; পদ্মনাভায় - পদ্ম নাভিতে যাঁর; দেবায় - দেবকে; হৃষীকপতয়ে - ইন্দ্রিয়াধিপতি; নমঃ - নমস্কার। 

সরলার্থ : বিশ্বরূপকে অর্থাৎ বিষ্ণুদেবতাকে প্রণাম। শঙ্খচক্রধারীকে, পদ্মনাভকে, ইন্দ্রিয়াধিপতি নারায়ণদেবকে প্ৰণাম।

নারায়ণ পূজার গুরুত্ব :

নারায়ণদেব এ জগতের সকল প্রাণীর পালনকর্তা। নারায়ণদেবের কাছ থেকে আমরা সন্তানাদিসহ পৃথিবীর সকল প্রাণীকে দায়িত্বের সঙ্গে পালন করার শিক্ষা পাই। তিনি সকল প্রাণীর মধ্যে আত্মারূপে বিরাজ করেন। তাই আমরা ঈশ্বরজ্ঞানে মানুষসহ সকল প্রাণীকুলকে সেবা করে থাকি। নারায়ণদেবের পূজা করলে পূজারীর মধ্যে নম্রতাবোধ জাগ্রত হয়। নারায়ণদেবের আশীর্বাদে ভক্তের গৃহে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজ করে। পাপ মোচন হয় এবং সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই ভক্তরা গৃহের সকল বাধা দূর করার জন্য ভক্তিভরে নারায়ণপূজা করেন এবং তাঁর মহিমা কীর্তন করেন।

Content added || updated By

মঙ্গলকর আচার-আচরণই হলো পার্বণ। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এই পার্বণসমূহ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একে ধর্মাচারও বলা যেতে পারে। আবহমানকাল থেকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে উৎসব আনন্দের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন পার্বণ পালিত হয়। আমাদের পালিত পার্বণগুলোর মধ্যে নববর্ষ, বিভিন্ন সংক্রান্তি উৎসব, দোলযাত্রা, বসন্তোৎসব, বর্ষা উৎসব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পূর্ববর্তী শ্রেণিতে আমরা নববর্ষ ও পৌষসংক্রান্তি সম্পর্কে জেনেছি। এখন আমরা চৈত্রসংক্রান্তি ও দোলযাত্রা সম্পর্কে জানব।

চৈত্রসংক্রান্তি

বাংলা মাসের শেষ দিনটিকে বলা হয় সংক্রান্তি। সেই ধারাবাহিকতায় চৈত্র মাসের শেষ দিনটিকে বলা হয় চৈত্রসংক্রান্তি। এ দিনটি বাংলা বছরের শেষ দিনও বটে। এ দিনকে ঘিরে থাকে নানা অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন। চৈত্রসংক্রান্তি অনুসরণ করেই আসে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ। শাস্ত্র, ধর্মীয় বিশ্বাস ও লোকাচার অনুসারে চৈত্র সংক্রান্তির এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস, নানাবিধ পূজা-পার্বণ প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পুণ্যজনক মনে করা হয়। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য আর লোকায়ত উৎসবের আমেজ পাওয়া যায় এই দিনটিকে ঘিরে। চৈত্রসংক্রান্তি উদ্‌যাপন উপলক্ষ্যে অঞ্চলভেদে নানাবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আমরা এখন কয়েকটি পার্বণ সম্পর্কে জানব।

চৈত্রসংক্রান্তিতে ঘুড়ি উড়ানো

নীলপূজা

চৈত্রসংক্রান্তি উদযাপনে শিব বা নীলপূজার আয়োজন করা হয়। এ দিন ভক্তরা নীলকে সুসজ্জিত করে গীতিবাদ্য সহযোগে বাড়ি বাড়ি ঘোরান এবং ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। নীলের গানকে বলা হয় অষ্টক গান। সন্ধ্যাবেলায় সকলের কল্যাণার্থে ভক্তরা প্রদীপ জ্বালিয়ে নানা উপচার দিয়ে শিবপূজা করেন। এরপর প্রসাদের মাধ্যমে সারাদিনের উপবাস ভঙ্গ করেন। নীলপূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নীল নাচ এবং শিবের গাজন। উত্তরবঙ্গে কোনো কোনো অঞ্চলে একে গম্ভীরা পূজা বলে।

নীল্পূজা

চড়কপূজা

লোকউৎসব হিসেবে চড়কপূজা বেশ পরিচিত। চড়কপূজা উপলক্ষ্যে যে আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে তা অনেক এলাকায় গাজন, গম্ভীরাপূজা বা নীলপূজা নামে পরিচিত। চৈত্রের দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে বৃষ্টির জন্য চাষিরা পালা গানের আয়োজন করে থাকে। যারা চড়কপূজা উপভোগ করতে আসে তারা কোনো ধর্মের বাঁধনে আবদ্ধ নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা সময়জুড়েই মেলা চলতে থাকে মহাসমারোহে। চড়কপূজা যদিও নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠান কিন্তু একে কেন্দ্র করে যে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তাতে বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।

চৈত্রসংক্রান্তি উদ্‌যাপন উপলক্ষ্যে অঞ্চলভেদে আরও নানাবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

চৈত্রসংক্রান্তির দিনে গ্রামবাংলায় খাওয়া হয় ছাতু, দই ও পাকা বেল সহযোগে এক বিশেষ শরবত। এদিনে নারীরা একটি নির্দিষ্ট খেজুরগাছের গোড়ায় দুধ এবং ডাবের জল ঢেলে পূজা করেন। পূজা শেষে একজন খেজুরগাছ থেকে খেজুর-ভাঙা ভক্তদের মাঝে বিলাতে থাকেন। সেই খেজুর খেয়ে উপোস ভঙ্গ করেন ভক্তরা। একে খেজুর ভাঙ্গা উৎসব বলে।

চড়কপূজা

 

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বৈসাবি উৎসব

চৈত্রসংক্রান্তি বাঙালি ছাড়াও উদ্‌যাপন করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরাও। তাঁদের ভাষায় বৈসাবি পালিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের দিনে। বৈসাবি শব্দটির ‘বৈ’ এসেছে ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’ থেকে, ‘সা’ এসেছে মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ থেকে এবং ‘বি’ শব্দটি চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের ‘বিজু’ থেকে। বিভিন্ন লৌকিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সকলের মঙ্গলের জন্য বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

 

দোলযাত্রা

ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির নিয়ে শ্রীরাধিকা ও অন্যান্য গোপীর সঙ্গে রং খেলেছিলেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস সেখান থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। এই ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন সকালে রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহে আবির রঙে রাঙিয়ে পূজা করা হয়। একে দোলপূজাও বলা হয়। রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এজন্য উৎসবটিকে দোলযাত্রা বলা হয়। এসময় ভক্তরা আবির খেলে পরস্পরকে রাঙিয়ে দেন। ফাল্গুনী পূর্ণিমার এই দিনে রাধা-কৃষ্ণকে দোলায় দুলিয়ে রং খেলা হয় বলেই এদিনকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। এ পূজার পূর্বরাত শুক্লা চতুর্দশীতে খড়কুটা জ্বালিয়ে অগ্নি- উৎসব করা হয়। একে মেড়া পোড়ানো কিংবা বুড়ির ঘর পোড়ানো বলা হয়। ভক্তদের বিশ্বাস, বুড়ির ঘর আগুনে পুড়িয়ে অমঙ্গলকে তাড়ানো হয়।

দোলযাত্রায় আবির খেলা

দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ সর্বজনীন দিকও রয়েছে। এই দিন সকাল থেকেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আবির ও বিভিন্ন প্রকার রং নিয়ে খেলায় মেতে ওঠেন। একে বসন্ত উৎসবও বলা হয়। কোথাও কোথাও এটি হোলি উৎসব নামে পরিচিত।

দোলযাত্রার গুরুত্ব 

দোল উৎসবের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গুরুত্ব অনেক। উৎসবমুখর এই দিনে সবাই অতীতের সমস্ত দোষত্রুটি, ঝগড়া-বিবাদ ভুলে গিয়ে রং খেলায় মেতে ওঠে। পরমতসহিষ্ণুতার বৃদ্ধি ঘটে। এক অপরকে ক্ষমা করে। সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। উৎসবস্থলে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীর মেলা বসে। গৃহস্থালির অনেক সামগ্ৰী মেলায় পাওয়া যায়। সাধারণের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়।

Content added || updated By

মন্দিরে দেবতার পুজো করা হয়। এজন্য মন্দিরকে বলা হয় দেবালয়। দেবদেবীর নাম অনুসারে মন্দিরের নাম হয়ে থাকে। যেমন - কালী মন্দির, দুর্গা মান্দির, শিব মন্দির, আদিনাথ মন্দির, লক্ষ্মী মন্দির, কান্তজী মন্দির, কৃষ্ণ মন্দির, বিষ্ণু মন্দির ইত্যাদি। আবার স্থানের নাম অনুসারেও মন্দিরের নাম হয়ে থাকে। যেমন - ঢাকেশ্বরী মন্দির, রমনা মন্দির ইত্যাদি। অনেক জায়গায় এসব মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক সাধুসঙ্ঘ। তাঁদের আবাসস্থল। বিভিন্ন আশ্রম। সাধুদের লীলাক্ষেত্র বা বিচরণক্ষেত্রগুলো সবই পুণ্যক্ষেত্র। এই পুণ্যক্ষেত্রগুলো আবার তীর্থক্ষেত্র হিসেবেও পরিচিত। সকল মন্দির ও তীর্থক্ষেত্রে গেলে মন ভালো হয়। পবিত্রতা বেড়ে যায়। মনে আসে প্রশান্তি। এগুলো আমাদের ঐতিহ্যও বটে। আমরা এখন দুটি মন্দির ও দুটি তীর্থক্ষেত্র সম্পর্কে জানব।

কান্তজী মন্দির

কান্তজী মন্দির বা কান্তজিউ মন্দির বাংলাদেশের দিনাজপুরে ঢেঁপা নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির। এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কান্ত বা কৃষ্ণের মন্দির হিসেবে পরিচিতি। এটি অষ্টাদশ শতাব্দীর মন্দির। বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শন রয়েছে এ মন্দিরে। ১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন স্থানীয় রাজা প্রাণনাথ রায় মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পালিত সন্তান রাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। দীর্ঘ ৪৮ বছর শতাধিক শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই কান্তজীর মন্দির। মন্দিরের বাইরে পুরো দেয়াল জুড়ে টেরাকোটার টালিতে রয়েছে রামায়ণ, মহাভারতসহ বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনির চিত্রায়ণ। এ কারণেই এ কান্তজির মন্দিরটি বাংলার স্থাপত্যশিল্প বৈশিষ্ট্যে অন্যতম। শ্রীকৃষ্ণের কাহিনিসমূহকে এখানে জনসাধারণের জীবনের মতো চিত্রায়িত করা হয়েছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পৌরাণিক ঘটনা। পৌরাণিক কাহিনির লৌকিক উপস্থাপনে তাই কারিগরদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতার এক অনন্য নিদর্শন এই কান্তজীর মন্দির।

কান্তজীর মন্দিরের দেওয়ালের ওপর পোড়ামাটির এ বিশাল অলংকরণ সে সময়ের জীব ও প্রাণশক্তিরই প্রকাশ এবং হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের পলিময় মাটিতে লালিত শক্তির ভেতর থেকেই এ শিল্প বেড়ে উঠেছিল।

এখানে রাধা-কৃষ্ণের পূজার পাশাপাশি প্রতি বছর মহাসমারোহে কার্তিক মাসের রাস পূর্ণিমায় রাস উৎসব হয়। ভগবানের আরাধনা ও পুণ্য লাভ করতে ভক্তরা এখানে আসেন। বহু বছর ধরে হিন্দুধর্মের ঐতিহ্য হিসেবে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ হচ্ছে এই রাসমেলা।

আদিনাথ মন্দির

বাংলাদেশের বিখ্যাত মন্দিরগুলোর মধ্যে আদিনাথ মন্দির অন্যতম। এটি কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত দ্বীপ মহেশখালিতে অবস্থিত। দেবাদিদেব মহাদেবের নামানুসারে এ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে এটি শিব মন্দির নামেও পরিচিত। এ মন্দিরটি মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। আদিনাথের অপর নাম মহেশ। মহেশের নামানুকরণে এ জনপদের নামকরণ করা হয় মহেশখালি। অধিকাংশ প্রাচীন মন্দির এবং তীর্থস্থান নিয়ে আছে অনেক পুরাণকথা, লোককথা। যেখানে ইতিহাস পাওয়া যায় না, সেখানে লোককথার ওপর নির্ভর করতে হয়। এখানেও লোককথা থেকে এ মন্দিরটি সম্পর্কে জানা যায়।

Content added By